জুমার সারাদিনে করণীয় | Friday (Jumu'ah) Day Amal & Sunnah – কুরআন ও হাদীসের আলোকে পূর্ণ দিকনির্দেশনা
লেখক: মুহাম্মদ খায়রুল ইসলাম |
ব্লগ: SunnahLife24.blogspot.com
✨ ভূমিকা:
“يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ”
(সূরা জুমু'আ: ৯)
জুমার দিন মুসলমানদের জন্য এক বিশেষ রহমতের দিন। এই দিনকে বলা হয় “সপ্তাহের ঈদ”। রাসূল ﷺ বলেন,
> “সবচেয়ে উত্তম দিন হলো জুমার দিন। এই দিনেই আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয়েছে।”
(সহীহ মুসলিম)
এই পোস্টে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব—জুমার দিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত করণীয় আমল, ফজিলত, দোয়া, সুন্নাত, নিষেধাজ্ঞা ও বাস্তব জীবনে করণীয় গাইড।
---
🕓 সূচিপত্র:
1. জুমার দিনের মাহাত্ম্য ও ফজিলত
2. ভোর থেকে ফজর পর্যন্ত করণীয়
3. সকালবেলা যোহরের পূর্ব পর্যন্ত আমল
4. জুমার খুতবা ও নামাজের আদব
5. যোহর পরবর্তী সময়: আসরের আগ পর্যন্ত করণীয়
6. আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত বিশেষ দোয়া ও আমল
7. জুমার দিনের গুরুত্বপূর্ণ দোয়া
8. জুমার দিনে যে বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা উচিত
9. বাচ্চাদের জুমার শিক্ষা ও চর্চা
10. উপসংহার ও বাস্তবিক পরামর্শ
---
১. জুমার দিনের মাহাত্ম্য ও ফজিলত
📘 কুরআনে:
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন:
> "তোমরা যখন জুমার দিনে সালাতের জন্য আহবান শুনবে, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও ও বেচাকেনা পরিত্যাগ করো।"
[সূরা জুমুআ: ৯]
📜 হাদীস অনুযায়ী ফজিলত:
আদম (আ.) সৃষ্টির দিন
জান্নাতে প্রবেশ ও বের হবার দিন
দোয়া কবুলের নির্দিষ্ট সময়
কিয়ামত সংঘটিত হবে শুক্রবার
---
২. 🌅 ভোর থেকে ফজর পর্যন্ত করণীয়
🔹 ১. তাহাজ্জুদের সালাত:
দোয়া কবুলের অন্যতম সময়। জুমার দিনে এই সময়টি বেশি বরকতময়।
🔹 ২. ইস্তেগফার ও তাওবা:
“আস্তাগফিরুল্লাহ” জিকির বেশি বেশি করুন।
🔹 ৩. ফজরের নামাজ জামাআতে আদায়:
> রাসূল ﷺ বলেছেন,
“ফজরের নামাজ জামাতে পড়লে সারা রাত ইবাদতের সওয়াব হয়।” (তিরমিযী)
---
৩. ☀️ সকালবেলা যোহরের পূর্ব পর্যন্ত করণীয়
🔹 ৪. গোসল করা:
> “জুমার দিনে গোসল করা ওয়াজিব” (বুখারি)
গোসল করে উত্তম পোশাক পরা এবং সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নাত।
🔹 ৫. মিসওয়াক করা:
দাঁত পরিষ্কার রাখা এবং মুখকে সজীব রাখা সুন্নাত।
🔹 ৬. ভালো পোশাক ও আতর ব্যবহার:
নবীজি ﷺ জুমার দিনে আতর ব্যবহার করতেন। (আবু দাউদ)
🔹 ৭. সূরা কাহফ তিলাওয়াত:
> “যে ব্যক্তি জুমার দিনে সূরা কাহফ পড়ে, সে দুই জুমার মাঝে আলোর নূর লাভ করে।” (হাকিম)
🔹 ৮. প্রথম দিকে মসজিদে যাওয়া:
যারা আগেভাগে যায়, তাদের জন্য উট কুরবানি করার সওয়াব। (বুখারি)
---
৪. 🕌 জুমার নামাজ ও খুতবার আদব
🔹 ৯. খুতবার সময় একদম চুপ থাকা:
> "যে ব্যক্তি খুতবার সময় ‘চুপ থাকো’ বলে, সে-ও কথা বলল।” (মুসলিম)
🔹 ১০. খুতবা মনোযোগ দিয়ে শোনা:
কথা, মোবাইল দেখা, চেহারা ঘোরানো – সব নিষিদ্ধ।
🔹 ১১. ইমামের জন্য দোয়া:
খুতবা শেষে মন থেকে ইমামের জন্য দোয়া করা।
🔹 ১২. খুতবার আগে ৪ রাকাত সুন্নাত ও পরে ৪ রাকাত সুন্নাত নামাজ
---
৫. 🕓 যোহর পরবর্তী সময়: আসরের আগ পর্যন্ত করণীয়
🔹 ১৩. দরূদ শরীফ বেশি বেশি পড়া:
জুমার দিনে সর্বাধিক দরূদ পড়া রসূল ﷺ এর প্রতি ভালোবাসার প্রমাণ।
🔹 ১৪. সূরা কাহফ শেষ করা (যদি শুরু করেন নি)
🔹 ১৫. আত্মপর্যালোচনা ও তাওবা:
সপ্তাহের গুনাহ বিশ্লেষণ করে তাওবা করুন।
---
৬. 🌇 আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত: বিশেষ আমলের সময়
🔹 ১৬. দোয়া কবুলের সময়:
> “আসরের পর এক বিশেষ মুহূর্ত আছে, যেখানে দোয়া কবুল হয়।” (আহমদ)
🔹 ১৭. দরূদ শরীফ পুনরায় পড়া
🔹 ১৮. পরকালের চিন্তা, জান্নাতের জন্য আমল
---
৭. 📿 গুরুত্বপূর্ণ দোয়া ও জিকির
✅ দরূদ ইব্রাহিম:
اللهم صل على محمد وعلى آل محمد...
✅ ইস্তিগফার:
أستغفر الله العظيم وأتوب إليه
✅ দোয়া কবুলের জন্য:
اللهم إني أسألك الجنة وأعوذ بك من النار
---
৮. ❌ জুমার দিনে যে বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা উচিত
1. খুতবার সময় কথা বলা
2. মোবাইল চালানো
3. ঘুমিয়ে পড়া বা অলসতা
4. গীবত, মিথ্যা, বাজে ভাষা ব্যবহার
5. সালাত বিলম্ব করা বা মসজিদে দেরি করে যাওয়া
---
৯. 👶 বাচ্চাদের জুমার শিক্ষা
ছোটবেলা থেকেই তাদের জুমার দিনে গোসল, আতর, সুন্দর পোশাক, খুতবা শুনা, জামাতে সালাত—এই গুলো শেখানো উচিত।
> প্রিয় পিতা-মাতা, আপনি সন্তানকে যদি ছোটবেলা থেকেই জুমার প্রতি ভালোবাসা শেখান, সে সারাজীবন ইসলামি আদর্শে জীবন কাটাবে।
জুমার দিনের ২৫টি বোনাস টিপস (সুন্নাহ ও হেকমতের আলোকে)
---
✅ ১. জুমার দিন "ইদুল আসবু" অর্থাৎ সাপ্তাহিক ঈদের দিন মনে করে উদযাপন করুন
> রাসূল ﷺ বলেছেন, “জুমা মুসলমানদের জন্য ঈদের দিন” (ইবনে মাজাহ)
---
✅ ২. জুমার রাতে সূরা কাহফ মুখস্থ করলে বেশি বরকত হয়
---
✅ ৩. জুমার দিন দান করলে সওয়াব দ্বিগুণ হয়
> আল্লাহ বলেন, “তোমরা উত্তম জিনিস দান করো।” – এই দিনে তার ফজিলত বহুগুণ।
---
✅ ৪. জুমার আগে ও পরে দোস্ত-আত্মীয়দের খোঁজ নিন
---
✅ ৫. আল্লাহর ৯৯টি নাম থেকে অন্তত ১০টি মুখস্থ করুন এবং জিকির করুন
---
✅ ৬. সন্তানদের সঙ্গে জুমার তাৎপর্য নিয়ে ৫ মিনিটের আলোচনা করুন
---
✅ ৭. জুমার দিন একটি হাদীস মুখস্থ করুন (জুমার হাদীস হোক)
---
✅ ৮. পকেটে কিছু খুচরা টাকা রাখুন, দান করার নিয়তে
---
✅ ৯. সকালবেলা “আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ...” ১০০ বার পড়ুন
---
✅ ১০. অসুস্থ বা অনুপস্থিত মুসল্লিদের খোঁজ নিন
---
✅ ১১. জুমার দিন কোনো মুসলিম ভাইকে উপহার দিন (ছোট হলেও)
---
✅ ১২. নামাজের আগ মুহূর্তে ফোন সাইলেন্ট করুন – মুসল্লিদের বিরক্তি রোধে
---
✅ ১৩. খুতবার সময় অন্যকে “চুপ” বলাও নিষেধ – শুধু মনোযোগ দিন
---
✅ ১৪. মসজিদে সবার আগে পৌঁছানো চেষ্টা করুন
---
✅ ১৫. লম্বা সিজদায় গোপন করে দোয়া করুন – সবচেয়ে প্রভাবশালী সময়
---
✅ ১৬. জুমার দিন কোনো ভাইয়ের সঙ্গে মনোমালিন্য থাকলে মাফ করে দিন
---
✅ ১৭. জুমার দিনে অন্তত একজন গরীব মানুষকে খাওয়ান
---
✅ ১৮. মেয়েদেরকে (পরিবারে) জুমার দিনের তাৎপর্য শেখান
---
✅ ১৯. জুমার পর দরূদ শরীফ ১০০ বার পড়া—বিশেষ বরকতের মাধ্যম
---
✅ ২০. সূরা দোহার তাফসীর পড়ুন – দুঃখী মনকে শক্তি জোগায়
---
✅ ২১. ঘরে/ফোনে ইসলামি বই বা ভিডিও দেখা, গান-মুভি এড়িয়ে চলা
---
✅ ২২. ফজর নামাজের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে থেকে জিকির করায় উমরাহর সওয়াব
---
✅ ২৩. একটি ভুল আমল থেকে নিজেকে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করুন
---
✅ ২৪. একজন মানুষকে ইসলামের পথে উৎসাহিত করুন
---
✅ ২৫. রাতের বেলা ঘুমানোর আগে দিনটিকে মূল্যায়ন করুন—"আজকের জুমা কতটা কাজে লাগিয়েছি?"
জুমার দিন ও নামাজ নিয়ে সবচেয়ে বেশি জিজ্ঞাসিত প্রশ্নোত্তর (FAQ)
---
✅ ১. জুমার নামাজ কবে, কখন পড়া হয়?
উত্তর: জুমার নামাজ প্রতি শুক্রবার (ইসলামি সপ্তাহের ৬ষ্ঠ দিন) পড়া হয়। সময় হয় যোহরের ওয়াক্তে, সাধারণত দুপুর ১২টা থেকে ২টার মধ্যে (স্থানভেদে ভিন্ন হতে পারে)।
---
✅ ২. জুমার নামাজ কি ফরজ?
উত্তর: হ্যাঁ, বালেগ, সুস্থ এবং স্থায়ী পুরুষদের জন্য জুমার নামাজ ফরজ। মহিলাদের জন্য ফরজ নয়, তবে পড়লে সওয়াব পাবেন।
---
✅ ৩. জুমার দিনে গোসল করা কি ওয়াজিব?
উত্তর: গোসল করা সুন্নাত মুয়াক্কাদাহ। তবে কারও শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হলে তার জন্য ওয়াজিব।
---
✅ ৪. জুমার দিনে কত রাকাত নামাজ হয়?
উত্তর:
ফরজ: ২ রাকাত (জামাআতে)
খুতবার আগে: ৪ রাকাত সুন্নাত
ফরজের পর: ৪ রাকাত সুন্নাত (হানাফি মতে)
এরপর আরও ২ রাকাত নফল পড়া যায়
---
✅ ৫. জুমার খুতবার সময় কথা বলা যাবে কি?
উত্তর: না, খুতবার সময় একদম চুপ থাকতে হবে—even কেউ কথা বললেও ‘চুপ’ বলাও নিষেধ।
---
✅ ৬. মেয়েরা কি জুমার নামাজ পড়বে?
উত্তর: মেয়েদের উপর জুমার নামাজ ফরজ নয়। তারা ঘরে যোহরের নামাজ আদায় করবে।
---
✅ ৭. জুমার দিনে সূরা কাহফ পড়ার ফজিলত কী?
উত্তর: হাদীসে এসেছে, “যে ব্যক্তি জুমার দিনে সূরা কাহফ পড়বে, তার দুই জুমার মাঝে নূর থাকবে।” (হাকিম)
---
✅ ৮. জুমার নামাজ না পড়লে কী হয়?
উত্তর: রাসূল ﷺ বলেন, “যে ব্যক্তি তিনটি জুমা ইচ্ছাকৃতভাবে ছেড়ে দেয়, আল্লাহ তার অন্তর মোহর মেরে দেন।” (আবু দাউদ)
---
✅ ৯. জুমার দিন কোন সময় দোয়া কবুল হয়?
উত্তর: সবচেয়ে কবুলযোগ্য সময় হলো আসরের পর মাগরিবের আগ মুহূর্ত। কিছু মত অনুযায়ী, খুতবার সময়ও দোয়া কবুল হতে পারে।
---
✅ ১০. জুমার খুতবা কিভাবে দেওয়া হয়?
উত্তর: ইমাম দুই খুতবা দেন—প্রথম খুতবায় ওয়াজ, দ্বিতীয় খুতবায় দোয়া। খুতবার সময় মুসল্লিদের চুপ থাকতে হয় এবং মনোযোগ দিতে হয়।
---
✅ ১১. জুমার দিন রোজা রাখা যাবে?
উত্তর: শুধু শুক্রবারে রোজা রাখা মাকরূহ। তবে আগে বা পরে (বৃহস্পতিবার/শনিবার) একদিন বাড়িয়ে রাখলে জায়েজ।
---
✅ ১২. জুমার দিন বিশেষ কোনো দোয়া আছে?
উত্তর: দরূদ শরীফ ও ইস্তিগফার বেশি বেশি পড়তে বলা হয়েছে।
বিশেষ দোয়া:
> اللهم اجعلني من أهل الجنة ونجني من النار
(“হে আল্লাহ, আমাকে জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করুন ও জাহান্নাম থেকে মুক্ত করুন।”)
উপসংহার :
জুমার দিন শুধু একটি সাধারণ দিন নয়—এটি মুসলমানদের জন্য একটি বিশেষ রহমতের দিন, যাকে বলা হয় "সপ্তাহের ঈদ"। এই দিন আল্লাহ তা'আলা তাঁর বান্দাদের প্রতি অশেষ দয়া ও মাগফিরাতের দরজা খুলে দেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাত, সাহাবিদের আমল এবং আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী যদি আমরা জুমার দিনকে সযত্নে পালন করি, তবে নিশ্চিতভাবেই আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে ফায়দা লাভ করতে পারব।
আজকের আধুনিক জীবনে জুমার গুরুত্ব অনেক সময় হালকা মনে হয়—বাজার, ব্যবসা বা ঘুমকে আমরা অগ্রাধিকার দিই। অথচ এই দিনটি আমাদের আত্মিক উন্নয়ন, গুনাহ মোচন এবং জান্নাতের পথে এক সোনালী সুযোগ। এজন্যই কুরআনে জুমার নামাজের আহ্বানে "ফয’উ" (ছুটে যাও) বলা হয়েছে, আর দুনিয়াবি কাজকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (সূরা জুমু‘আ: ৯)
আমরা যদি এ দিনে—
সময়মতো গোসল করে,
পরিষ্কার পোশাকে,
সুন্দর আতর মেখে,
তাড়াতাড়ি মসজিদে গিয়ে,
খুতবার প্রতি মনোযোগী হয়ে,
হৃদয় খাঁটি করে জুমার নামাজ আদায় করি,
তবে আমাদের এই আমল হবে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় ইবাদতের একটি। উপরন্তু, এই দিনে দোয়া কবুলের এক গোপন সময় রয়েছে—যে সময় যদি বান্দা আন্তরিকভাবে কিছু চায়, আল্লাহ তা ফিরিয়ে দেন না।
🕋 তাই আসুন...
আমরা জুমার দিনের গুরুত্বকে হৃদয়ে ধারণ করি।
এই দিনের সুন্নতগুলো পালন করে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করি।
জুমার নামাজের মাধ্যমে জীবনের সপ্তাহিক একটা “রিফ্রেশ” তৈরি করি।
দুনিয়ার ব্যস্ততায় নয়, পরকালের চিন্তায় এই দিনটিকে সাজাই।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে জুমার দিনের ফজিলত যথাযথভাবে বুঝে তা অনুসরণ করার তাওফিক দিন।
আল্লাহুম্মা আমীন।
---
🔗 পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না। অন্যদের জুমার ফজিলত ও সুন্নত জানার সুযোগ করে দিন।
Join the conversation