জুই ও পলাশের প্রেমের গল্প পর্ব- ১ গ্রামের মাটিতে জন্ম নেওয়া হৃদয় ছোঁয়া ভালোবাসা"
পর্ব-১ : বৃষ্টিভেজা পথে প্রথম দেখা, জীবনের শুরু
ভালোবাসা শব্দটা যত সহজ মনে হয়, তার ভেতরটা ঠিক ততটাই জটিল। হাজারো অনুভূতি, অজস্র স্বপ্ন, কষ্টের পাহাড়, অপেক্ষার লম্বা সময়—সব মিলে তবে তৈরি হয় একটা ভালোবাসা। আর যদি সেটা হয় প্রথম ভালোবাসা, তাহলে তার গুরুত্ব থাকে অনন্ত।
বরিশালের এক ছোট্ট গ্রাম, নাম শোলার চর। চারপাশে নদী-বিল, সবুজ মাঠ, কাঁচা রাস্তা আর গ্রামের সহজ-সরল মানুষ। আধুনিকতার ছোঁয়া কম, কিন্তু প্রকৃতির সৌন্দর্যে ভরা। গ্রামের ভোর মানেই পাখির ডাক, মাঠে কৃষকের কাজ, নদীর তীরে জেলে নৌকা আর হাট-বাজারের ছোটখাটো শব্দ।
এই গ্রামেই জন্ম পলাশের। বাবা সিরাজুল ইসলাম একজন কৃষক, মা রহিমা বেগম গৃহিণী। সংসারে অভাব থাকলেও সম্মানের কমতি নেই। পলাশের দুই ভাই, সে মেজো। পড়াশোনার প্রতি তীব্র আগ্রহ, চোখে বড় হওয়ার স্বপ্ন।
পলাশের শরীরের গড়ন মাঝারি, গায়ের রঙ শ্যামলা, মুখে সহজ-সরল ভাব। তবে চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, যা তার বয়সের তুলনায় অনেক বেশি বড় স্বপ্নের ইঙ্গিত দেয়।
পাশের গ্রাম মুন্সিরহাটে থাকে জুই। বাবা সাহেব আলী গ্রামের বাজারে কাপড়ের দোকানি, মা রিজিয়া বেগম ঘরের কাজ সামলান। জুই একমাত্র মেয়ে, চোখের মণি। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী, গান গাইতে ভালোবাসে, স্কুলে সবার পরিচিত মুখ। তার গায়ের রঙ ফর্সা, মুখে মিষ্টি হাসি, চোখে সাহস।
দুই গ্রামের দূরত্ব খুব বেশি নয়। গ্রামের মেলা, স্কুল, বাজার—এসব জায়গায় দুই গ্রামের মানুষজনের দেখা হয়।
পলাশ আর জুইয়ের প্রথম দেখা হয় বর্ষার এক সকালে।
সেইদিন আকাশ কালো মেঘে ভরা, মাঝে মাঝে বৃষ্টি ঝরছে। কাঁচা রাস্তা ভেজা, কাদায় ভরা। চারপাশে নদীর পানি ফুলে উঠেছে, বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে কদম ফুলের ঘ্রাণ।
পলাশ হেঁটে যাচ্ছিল বাজারের দিকে, মাথায় কোনো ছাতা নেই। চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ, পরিবার-সংসারের দায় মাথায়।
এদিকে জুইও স্কুলের পথে, হাতে ছোট ছাতা, স্কুলব্যাগে বই ভর্তি। রাস্তা পিচ্ছিল, বারবার পিছলে যাচ্ছে। হঠাৎ এক জায়গায় কাদায় পা আটকে যায়, ব্যালান্স হারিয়ে পড়ে যেতে যায়।
ঠিক সেই মুহূর্তে পেছন থেকে পলাশ এগিয়ে এসে তাকে ধরে ফেলে। দুই হাতে শক্ত করে ধরে, তার পড়া আটকায়।
জুই অবাক হয়ে তাকায়, পলাশও হতবাক। কয়েক সেকেন্ড চোখে চোখ। চারপাশের শব্দ থেমে যায়, যেন সময়টা স্তব্ধ হয়ে আছে।
জুই ফিসফিস করে বলে,
“ধন্যবাদ, রাস্তাটা খুব পিচ্ছিল।”
পলাশ হেসে বলে,
“পিচ্ছিল রাস্তার দোষ নয়, আপনি খেয়াল করেননি।”
জুই লজ্জায় মাথা নিচু করে, পলাশও অল্প হেসে সামনে হাঁটা দেয়। তবে সেই মুহূর্তটা তাদের দুজনের মনে রয়ে যায়, হৃদয়ে যেন কিছু একটা নড়ে ওঠে।
এরপর প্রায় প্রতিদিনই দেখা হতে থাকে।
একই স্কুল, একই রাস্তায় যাওয়া-আসা, প্রতিদিনের দেখা যেন তাদের অজান্তেই কাছে টেনে নেয়। প্রথম দিকে দুজনেই লজ্জায় কথা বলে না। পরে ধীরে ধীরে পরিচয়, চোখের ইশারা, ছোট ছোট কথা।
পলাশ বুঝতে পারে, জুই শুধু সুন্দর নয়, তার মনের ভেতর অনেক বড় কিছু আছে। সাহস, স্বপ্ন, দৃঢ়তা।
জুইও লক্ষ্য করে, পলাশ আলাদা। তার চোখে আলাদা দীপ্তি, কথায় ভরসা। সে সাধারণ ছেলে হলেও তার মনের শক্তি অসাধারণ।
একদিন স্কুল শেষে জুই নদীর ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। ঠান্ডা বাতাস বইছিল, জলের ঢেউ আছড়ে পড়ছিল।
পলাশ পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, বলে,
“তুমি গান গাও?”
জুই অবাক হয়ে তাকায়, লাজুকভাবে মাথা নাড়ে।
পলাশ বলে,
“দূর থেকে শুনেছি, তোমার গান মন ছুঁয়ে যায়।”
জুই হেসে বলে,
“গান গাইতে ভালো লাগে, তবে ভয়ও লাগে।”
পলাশ মৃদু হেসে বলে,
“ভয় কিসের? আমি আছি তো!”
সেই মুহূর্তটা থেকে তাদের বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়।
দিন যায়, রাত যায়।
কখনও হাটে দেখা, কখনও নদীর পারে, কখনও স্কুলে ক্লাস শেষে গল্প। ছোট ছোট বিষয় শেয়ার করা, বই দেওয়া-নেওয়া, একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকা—সব কিছুতেই তৈরি হতে থাকে এক অদৃশ্য সম্পর্ক।
কিন্তু গ্রামের মানুষজন তো বসে নেই। তারা কানাকানি শুরু করে,
“ওই দুইজন বেশি মেলামেশা করছে।”
“মেয়েটা সুন্দর, পাত্রের অভাব নেই।”
“ছেলেটার কিছুই নেই, কীভাবে চলবে?”
এসব কথা জুই শুনেও পাত্তা দেয় না। তার মনে গেঁথে গেছে পলাশের চোখের সেই দৃঢ়তা, তার স্বপ্ন।
একদিন মেলায় দুজন একসঙ্গে ঘোরে। মানুষের ভিড়, দোকানের সারি, আলোর ঝলক। পলাশ বলে,
“তুমি জানো, আমি তোমার জন্য নিজেকে তৈরি করব। বড় হবো, তোমার যোগ্য হবো।”
জুই চুপ করে থাকে, চোখে জল জমে, তারপর বলে,
“তুমি যদি সত্যি কথা বলো, আমি তোমার অপেক্ষা করব।”
তবে বাস্তবতা সহজ নয়।
জুইয়ের বাবা-মা তার জন্য ঢাকায় বড়লোক পাত্র দেখছে। পলাশের হাতে এখনো কিছু নেই।
একদিন হাটে জুইয়ের খালাতো ভাই পলাশকে অপমান করে, বলে,
“তুই গরিবের ঘরে জন্ম নিয়ে আমাদের পরিবারের মেয়েকে ভাবিস?”
পলাশ কিছু বলে না, ভেতরে রাগ জমে যায়। সে প্রতিজ্ঞা করে, নিজেকে প্রমাণ করবেই।
জুইও সাহস করে পরিবারকে বলে,
“আমি শুধু পলাশকেই চাই।”
পরিস্থিতি জটিল হয়, জুইকে স্কুলে যেতে দেওয়া হয় না, বাইরে বের হতে দেওয়া হয় না।
পলাশ সিদ্ধান্ত নেয়, সে শহরে যাবে, পড়াশোনা করে বড় হবে। নিজের অবস্থান তৈরি করে ফিরে আসবে।
বিদায়ের দিন সকালে আকাশ মেঘলা, বাতাস ভারী।
জুই আড়াল থেকে দেখে, পলাশ গ্রামের রাস্তা ধরে যাচ্ছে। চোখে স্বপ্ন, মনে প্রতিজ্ঞা।
পলাশও দূর থেকে দেখে, তার ভালোবাসা অপেক্ষায় আছে।
এইভাবেই শুরু হয় অপেক্ষার সময়, ভালোবাসার যুদ্ধ।
Join the conversation