জুই ও পলাশের প্রেমের গল্প পর্ব ৩ – ভালোবাসার মাঝে হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা
“ভালোবাসার মাঝে হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা”
১. রাতের ফোনকল
রাত তখন পৌনে ১২টা। শহরের অধিকাংশ আলো নিভে গেছে, শুধু দু’একটা ল্যাম্পপোস্ট কুয়াশার মতো আলো ফেলছে। পলাশ ফোনটা হাতে নিয়ে বারবার নাম্বারটা স্ক্রিনে দেখছে। কল করবে, নাকি করবে না—এই দ্বন্দ্বে অস্থির সে।
শেষতক সাহস করে ডায়াল করলো।
একবার... দুইবার... তিনবার...
"হ্যালো..."
জুইয়ের কণ্ঠে ঘুমের ছোঁয়া, কিন্তু কণ্ঠে একটা নরমতা ছিলো যা পলাশকে নিঃশব্দে শান্তি দিতো।
— পলাশ ধীরে বললো, “ঘুমাচ্ছো?”
— জুই, “ঘুম আসছিল, কিন্তু এখন তো তুমি ডিস্টার্ব করছো।”
— “তাহলে রাখি?”
— “রাখো না… বলো, কী হয়েছে?”
একটা ছোট্ট নিরবতা। তারপর পলাশ বললো,
“ভালোবাসা কি সত্যিই বাঁচিয়ে রাখা যায়, জুই?”
জুই চুপ করে থাকে। যেন এই প্রশ্নটা অনেক পুরোনো, অনেক ভারী।
২. হারিয়ে যাওয়া বারান্দা
জুই বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ফোনটা হাতে। চাঁদের আলো গায়ে মেখে নেয়। এই আলো একসময় পলাশের সাথে ভাগ করতো, এখন একা দেখে।
সে বলে, “ভালোবাসা তো একটা নদী, পলাশ। যদি দুই পাড় থেকে চেষ্টা না করি, তাহলে তো মাঝপথে শুকিয়ে যায়।”
— “তাহলে আমরা কী করছি এখন?”
— “তুমি চেষ্টা করছো, আমিও করি। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবন আমাদের পাড় আলাদা করে দিচ্ছে…”
পলাশের বুকটা মোচড় দেয়।
সে জানে, এ সম্পর্কের মাঝে শুধু আবেগ নয়, বাস্তবতাও কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়।
৩. পরিবারের ছায়া
পলাশের পরিবার এখনো জানে না সে একজন লেখক হতে চায়। ওর বাবা চান সে বিসিএস ক্যাডার হোক।
অন্যদিকে, জুইয়ের পরিবার চায়, তার বিয়ে হোক ‘ভালো ঘরে’।
একদিন জুইকে তার মা বললো,
— “বয়স তো বাড়ছেই, বিয়ের প্রস্তাব আসছে, আর কত দিন তোমার পলাশের অপেক্ষা করবো?”
জুই কিছু বলেনি। চুপ করে শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ছিলো বাইরে।
তার মা চলে যাওয়ার পর জুই ধীরে ধীরে বলেছিল,
“ভালোবাসা কখনো সময় দেখে না, মা...”
কিন্তু সমাজ তো সময়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ।
ভালোবাসা এখানে একটা বিলাসিতা মাত্র।
৪. দেখা—তিন মাস পর
তিন মাস পর জুই ও পলাশ দেখা করে। একটা বইমেলা উপলক্ষে।
জুই এসে দাঁড়ায় সেই পুরোনো চায়ের দোকানের সামনে।
পলাশ আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল।
দেখামাত্রই জুই চোখ সরিয়ে নেয়। পলাশ বুঝে যায়, দূরত্ব কেবল স্থানে নয়, মনে গাঁথাও।
তারা হেঁটে যায় ধীরে ধীরে। কথা কম, চুপ বেশি।
হঠাৎ পলাশ বলে,
— “তুমি বদলে গেছো, জুই।”
— “সময়ই তো বদলে দেয়, পলাশ।”
পলাশ হালকা হেসে বলে,
— “তবুও তোমার চোখে আমার সেই পুরোনো জুইকে দেখি।”
— “আর আমি এখনকার পলাশকে খুঁজে ফিরি।”
দুইজন হেসে ফেলে, কিন্তু সে হাসির মাঝে একটা দীর্ঘশ্বাস লুকানো থাকে।
৫. হঠাৎ পাওয়া চিঠি
এক রাতে পলাশ তার ডেস্কে পুরোনো ডায়েরি খুলে চিঠি খুঁজে পায়—
জুইয়ের লেখা...
> “পলাশ,
কখনো যদি আমি হারিয়ে যাই, জানবে আমি ভালোবাসি।
কিন্তু জীবন সব সময় ভালোবাসাকে ধরে রাখতে দেয় না।
আমি চাই, তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করো।
আমি থাকি না থাকি, তুমি যেন তুমি হও।
– জুই।”
পলাশ এই চিঠি পড়েই সেদিন সারারাত আর ঘুমাতে পারেনি।
চোখে জল, আর একরাশ হতাশা নিয়ে সে চেয়ে থাকে খালি আকাশে...
৬. নতুন চাকরি, পুরোনো ক্ষত
পলাশ অবশেষে একটা লেখালেখির প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি পায়।
একটা ছোট ম্যাগাজিনে কাজ। বেতন কম, স্বপ্ন বেশি।
জুই জানতে পেরে ফোন করে,
— “অভিনন্দন, পলাশ। তুমি পেরেছো!”
— “তুমি না থাকলে পারতাম না। আমি সবসময় তোমার অনুপ্রেরণাই খুঁজে পেয়েছি।”
কিন্তু এই ফোনকল এক রকম বিদায়ের মতো শোনায়।
জুই বলে,
“আমাদের সম্পর্কটা হয়তো লেখার মতোই, যেখানে শেষ নেই... কিন্তু পৃষ্ঠা বদলাতে হয়।”
৭. সম্পর্কের রূপান্তর
পলাশ একদিন সিদ্ধান্ত নেয়, সে আর জুইকে টানবে না।
সে চায় জুই নিজের মতো জীবন গড়ুক।
সে মেসেজ পাঠায়—
> “জুই, আমি তোমাকে দোয়া করি সব সময়।
আমি আর তোমার কাঁধ হতে চাই না। তুমি মুক্ত পাখি।
আমি থাকবো, তবে দূরে থেকে।
ভালো থেকো।”
জুই সে মেসেজ পড়ে দীর্ঘক্ষণ চুপ করে বসে থাকে।
তার চোখে পানি আসে। কিন্তু সে জানে, সম্পর্ক মানে দখল নয়, মুক্তি...
৮. হঠাৎ ফিরে দেখা
দুই বছর পর।
এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে পলাশ অতিথি হিসেবে যায়।
স্টেজে তার লেখা নিয়ে আলোচনা হয়। তার উপন্যাস—“তুমি না থাকলেও” তখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
অনুষ্ঠান শেষে একজন মেয়ের কণ্ঠে পরিচিত ডাক,
“পলাশ…”
সে ঘুরে দাঁড়ায়।
জুই।
তার চোখে একই চাহনি, কিন্তু মুখে নরম হাসি।
— “তোমার বই পড়েছি, খুব গভীর…”
— “তুমি কী খুঁজে পেয়েছো?”
— “আমাকে। আর তোমাকে।”
একটা দীর্ঘ নিরবতা। তারপর পলাশ বলে,
“এখন কেমন আছো?”
জুই হালকা হেসে বলে,
“ভালো আছি। তবে কোথাও কোথাও এখনো তুমি রয়ে গেছো।”
Join the conversation